Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

Image
Title
আদিনাথ মন্দির
Details

                                                                                                                         আদিনাথ মন্দির


বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত পর্যটন জেলা কক্সবাজার। জেলার অদূরে সাগর পাহাড়ের মিতালিতে গড়ে উঠেছে দেবাদিদেব 'মহেশের নামানুসারে সাগরকন্যা মহেশখালী উপজেলা। উপজেলার মৈনাক পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় দৃষ্টিনন্দন আদিনাথ মন্দিরের বর্তমান অবকাঠামো ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। আবার হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, কয়েক হাজার বছর পূর্বে ত্রেতাযুগে এ মন্দিরের গোড়াপত্তন হয়েছে। হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকজন মনে করেন আদিনাথ জ্ঞানময়, কল্যাণময়, মঙ্গলময়, চিরসত্য, শাশ্বত, সনাতন। তিনি ব্যাপ্ত চরাচরে অব্যক্ত ভগবান তাই সনাতন জনগণ মাত্রই শিবভক্ত, শিব উপাসক। মুক্তি লাভের এবং মনস্কামনা পূরণের জন্য শ্রী শ্রী আদিনাথ দর্শনই সর্বশ্রেষ্ঠ পুণ্য।
রামায়ণে বর্ণিত আছে, ত্রেতাযুগে রাম রাবণের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রামকে পরাজিত করার জন্য রাবণ শিবের উপাসনা করে অমরত্ব কামনা করেন। শিব বর দিয়ে শর্ত দিলেন, কৈলাস থেকে শিবরূপী শিবলিঙ্গ' মাথায় করে লঙ্কায় নিয়ে এসে পূজা করতে হবে। পথে কোথাও রাখা যাবে না। দৈবাৎ রাখলে তা আর উঠানো যাবে না। সেই স্থানেই অবস্থান নিবেন শিবলিঙ্গ। রাবণ শর্ত মেনে নিয়ে মহাদেবকে মাথায় করে রওনা হলেন। যাত্রা পথে এই মৈনাক' পর্বতে শিবকে রেখে রাবণ প্রাকৃতিক ডাক সেরে ফিরে এসে শিবকে আবার উঠাতে চাইলে শর্তানুযায়ী শিব আর উঠলেন না। এই মৈনাক' পর্বতেই হয়ে গেল তার অধিষ্ঠান। এভাবে অনেক বছর যাওয়ার পর এই মন্দির তীর্থস্থান হয়ে উঠে।
হিন্দু স¤প্রদায়ের এই তীর্থস্থানটি বিশেষ মর্যাদা পায় এই মহেশখালীর একজন সচ্ছল মুসলিমের হাতে। তার নাম নুর মোহাম্মদ সিকদার। তিনি খেয়াল করলেন তাঁর গোয়াল ঘরের এক দুধেল গাভী (কামধেনু) আগের মত দুধ দিচ্ছে না। রাতের অন্ধকারে গাভীটিকে অনুসরণ করে দেখলেন, মৈনাক পাহাড়ে এক 'শিলায়' গাভীটি দাঁড়িয়ে আছে আর দুধের ওলান থেকে দুধ ঝরে যাচ্ছে। এ দৃশ্যে তিনি হতবাক হয়ে গাভীটিকে নিয়ে এসে খুঁটির সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখলেন। রাতে স্বপ্নাদেশ পেলেন, দুধ দেয়া স্থানটিতে একটি মন্দির করতে এবং শিবের পূজা করার জন্য হিন্দু জমিদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। পরে তৎকালীন জমিদার মন্দির স্থাপন করেন এবং ধীরে ধীরে তা শিব তীর্থে প্রকাশিত হতে থাকে।
এ মন্দিরে যাতায়াত হতো নাগা সন্ন্যাসীর। গোরক্ষনাথ তাঁদেরই একজন। যাঁর নামানুসারে মহেশখালী উপজেলা হেডকোয়ার্টারের নাম গোরকঘাটা। তিনি শিবের নির্দেশ পান নেপাল থেকে 'অষ্টভূজা' মাতা, যা শিবের শক্তি রুপকে মহেশখালীতে নিয়ে আসতে। ১৬১২ সালে নেপালের রাজবাড়ির মন্দির থেকে 'অষ্টভূজা' মাতার মূর্তি গোপনে নিয়ে আসার সময় ধরা পড়ে যান নাগা সন্ন্যাসী । তিনি জেল বন্দী হয়ে পড়েন। যে দিন রায় ঘোষণা হবে আগের রাতে নাগা সন্ন্যাসী স্বপ্ন দেখেন, আদিনাথ তাঁকে বলছেন, বিচারক যে প্রশ্নই করুক সন্ন্যাসী যেন মুখে যাই আসে তাই বলে দেন। মহামান্য বিচারক নেপাল রাজাকে মূর্তির রং কেমন জানতে চাইলে রাজা বলেন, কষ্টিপাথরের মূর্তি, রং কালো। নাগা সন্ন্যাসী মহামান্য বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, মূর্তির রং সাদা। উপস্থিত সকলের সামনে মূর্তিটি যখন অনাবৃত করা হল, দেখা গেল রং সাদা। তাই নাগা সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় হয়। সেই থেকে শিবের সাথে পূজা হচ্ছে অষ্টভূজা' মায়ের। মহেশখালীতে স্বয়ং অষ্টভূজা রূপে দুর্গাদেবীর অধিষ্ঠান বলে এখানে দুর্গা প্রতিমা বানিয়ে শারদীয় দুর্গা উৎসব পালন করা হয় না, পূজা হয় ঘটে। এই অঙ্গনে বর্তমানে ভৈরব মন্দির, রাধা-গোবিন্দ মন্দির এবং শনি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মন্দিরের মাঝখানে বিরল প্রজাতির একটি পারিজাত ফুলগাছ আছে। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে গাছটি স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের রাজ উদ্যানের ফুল গাছ বলে উল্লেখ আছে। সৌভাগ্য এবং পুণ্যায়ী ফুলগাছ হিসেবে অনেকে সুতা জড়িয়ে বিভিন্ন মানত করে থাকেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮৮ ফুট উঁচুতে আদিনাথ মন্দিরের পেছনে দেখা যায় জোড়া পুকুর। অবাক বিষয় হল, অনেক উপরে হলেও জোড়া পুকুরের পানি কখনো শুকায় না। একটি পুকুরে স্নান করলে রোগমুক্তি হয়, অন্য পুকুরটিতে স্নান করলে জ্বর এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় মর্মে জনশ্রæতি আছে।
কোম্পানীর শাসন আমলে দেওয়ান ব্রজকিশোর লাল কানুনগোর প্রতিনিধি দেওয়ান কালিচরণ নয় বছরের কিশোর শরৎচন্দ্রসহ এই দ্বীপটি তৎকালীন শাসকদের নিকট থেকে ক্রয় করে নেন। শরৎচন্দ্র নাগা সন্ন্যাসী গোরক্ষনাথের সংস্পর্শে এসে জমিদারি সম্পত্তি আদিনাথের নামে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দান করে যান। আদিনাথ দ্বৈত ব্যবস্থাপনায় পুরী এ্যাক্ট অনুযায়ী মোহন্ত শাসনে ছিল। পরে এ মন্দির ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে সীতাকুÐ স্রাইন কমিটির অধীনে চলে যায় ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার তীর্থ যাত্রী পুণ্য অর্জনের জন্য এ মন্দিরে আসেন। প্রত্যেক বছরের ফাল্গুন মাসে কৃষ্ণ পক্ষের শিবচতুর্দশী তিথিতে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী শিব দর্শন করে পুণ্য সঞ্চয় করে থাকেন। এই শিবচতুর্দশী পূজা উপলক্ষ্যে ঐতিহাসিক মৈনাক পর্বতের  পাদদেশে পক্ষকাল ব্যাপী মেলা বসে। যুগযুগ ধরে চলে আসা এ মেলা অত্র অঞ্চলের সকল সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির মেলবন্ধন তৈরি করে আসছে।